This is the 70th letter
৭০
হৈমবতী
২১।৮।৬০
শিলং এর অবস্থা শান্তই আছে, কিন্তু সমস্ত আসামের অবস্থা এখনো স্বাভাবিক হয়নি । ‘শিষ্টের দমন দুষ্টের পালন’ যে দুঃশাসন নেহরুর নীতি, তাঁর আমলে কত দুর্ভোগই আমাদের ভুগতে হবে কে জানে ।যাক, তবুও আমরা মরব না ।
***********************
মহাপ্রভুর ছোট হরিদাস বর্জনটা কোনদিনই আমার কাছে ভাল লাগেনি। মাধবী দাসীর কাছ থেকে মহাপ্রভুর জন্য চাল ভিক্ষা করে আনাটা প্রকৃতি –সম্ভাষণের পর্যায়ে পড়ে technically নিশ্চয় , কিন্তু তিনি অন্তর্যামী হয়ে থাকেন, যদি তাহলে হরিদাসের মনোভাব বুঝতে পারলেন না ? আমি এটাকে মোটেই সমর্থন করতে পারি না । যাক। চাঁদেও কলঙ্ক থাকে ।
স্নেহাশিস নিও ।
This is the 69th letter
৬৯
হৈমবতী
২৫।৯।৬০
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ... ‘পুষ্পের পুষ্পত্ব সহজ কিস্তু মানুষের মনুষ্যত্ব সহজ নয়’ । কোথাটা বর্ণে বর্ণে সত্য। রামকৃষ্ণদেব বলতেন, ‘বড় ফুল ফুটতে দেরী হয়’ । মানুষ সেই বড় ফুল। ফুটতে দেরী তার হবেই । কিন্তু চরম ফোটার যে আনন্দ, তাকে এই মুহূর্তে সে অনুভব করতে পারে, যদি যে বৃহতের আলো তাকে ঘিরে আছে, তাকে সে সমস্ত হৃদয় দিয়ে স্বীকার করে। তখন মনে হয় , ‘আমি কি চাই, সেকথাটা বড় নয়, তুমি যে আছ সেই কথাটাই বড় । তোমার অস্তিত্বে আমার অস্তিত্ব । আর সেই সহজ প্রত্যয়ই চেতনার সকল ঐশ্বর্যের বাড়া । তখন তো আর কান্না থাকে না। প্রত্যাশা থাকে, ব্যথার মাধুরীও হয়তো থাকে একটুখানি –কিন্তু সব ছাপিয়ে থাকে সহজের নিবিড় স্পর্শ।
কিছু পেতে চেও না, তাহলে দুঃখ পাবে । প্রতি মুহূর্তে ধরা দাও ঐ আলোর বাহুবন্ধনে । সে উদ্যত বাহু তো কোন কালেই গুটিয়ে নাই ।
আশা করি ভাল আছ ।
স্নেহাশিস ।
This is the 68th letter
৬৮
হৈমবতী
১৫।৫।৬০।
অনেকদিন পরে এখানে বৃষ্টি হল। শিলং এর স্নিগ্ধতা আবার ফিরে এসেছে। বোধ হয় এতদিনে কলকাতাতেও বৃষ্টি হয়েছে।
একটা কিছু আমি পাব- এইটা মনে করাই ভুল । এতে প্রাপ্তিকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কোঠায় ফেলে দেওয়া হয়। সুতরাং এটা মিথ্যা দৃষ্টি – প্রাচীন মরমীয়াদের ভাষায় । সম্যগ দৃষ্টি হচ্ছে – তিনি আমায় পেয়েই রয়েছেন - এই অনুভব । এ অনুভব নিত্য বর্তমানের । তুমি নারী, তুমি সাধিকা , তুমি অসুস্থা-এর কোনটাই তোমার পরিচয় নয় । সব ছাপিয়ে এই পরিচয়ই সত্যও, তুমি শুদ্ধ চেতনা মাত্র, তুমি বোধ মাত্র। আর সেই বোধ তাঁরই নিঃশ্বসিত । তাঁর প্রতিটি নিঃশ্বাসে তিনি তোমায় হৃদয়ে আকর্ষন করছেন । আবার প্রশ্বাসে অনন্ত জ্যোতিতে বিচ্ছুরিত করছেন । তুমি তাঁর প্রাণাপানের ছন্দ । এই সহজ অনুভবটি তোমার হ’ক ।
বড় ব্যস্ত আছি ।
যাই। স্নেহাশিস।
This is the 67 th letter
৬৭
হৈমবতী
২৪।৪।৬০
শরীর একটা বোধ মাত্র । তোমার সে বোধ ব্যাপ্ত হ’ক , স্বচ্ছ হ’ক । বল,
আকাশ শরীরং ব্রহ্ম, প্রানারামং মন আনন্দং
শান্তি সমৃদ্ধম্ অমৃতম্ ।।
স্নেহাশিস ।
This is the 66th letter
৬৬
হৈমবতী
১০।৪।৬০
শুধু দেখে যাওয়ার চাইতে বড় আর কিছুই নাই । মনটি যদি আকাশের মত নির্মল আর ফাঁকা হয়ে যায়, তাহলে তাতে আলোই তো ফোটে শুধু – মেঘের ছায়া তো আর থাকে না। মেঘেও ইন্দ্রধনুর ছটা খেলতে পারে, সূর্যাস্তের আভা লাগতে পারে, কিন্তু তবুও আলোই তো সত্য। আর শে আলো আকাশের স্বীয়া প্রকৃতি। আকাশ শিব, আলো সতী ।
এই তো সত্য ।
স্নেহাশিস ।
This is the 63 rd letter
৬৩
হৈমবতী
২৯।১১।৫৯
বুদ্ধ সম্বন্ধে কি বলেছিলাম , তা মনে নাই। Descent of God বলতে এই বুঝি, আমার চেষ্টার যেখানে শেষ, অথচ দেখছি অহেতুক প্রসাদ ঝরে পড়ছে, তাকেই বলব Descen । ওখানে আর কার্য কারণ সম্পর্ক থাকল না। যতটুকু করি বা না করি, তার বেশী পাই। কেন পাই, তাও জানি না। এটা ব্যাক্তিতে অবতরণ। তাছাড়া সমষ্টির জন্য তাঁর অবতরণ হয় । গীতায় তার কথা আছে, তা তো জানই ।
এক ‘একমাত্র’ হওয়ার অর্থই হল তাঁর ঘনীভূত হওয়া । বিগ্রহ হওয়া । অবতরণের এইটি চরম অবস্থা । আমার দিক থেকে ওটি হল চেতনারই ঘনীভাবের ফল ; প্রথমত বিদেহ ভাব, তারপর ব্যোমতনুতে স্পন্দ । তাতে তেজের সমূহন । এই থেকে এটি হয়।
আশা করি , ভাল আছ ।
স্নেহাশিস ।
This is the 62nd letter
৬২
হৈমবতী
২০।৯।৫৯
ত্রিশঙ্কুর উল্লেখ ওখানে * ছাড়া আর কোথাও নাই। পৌরাণিক ত্রিশঙ্কুর সঙ্গে এঁর কোনও সম্পর্ক আছে কিনা বলা যায় না । নামটার অর্থ : যাঁর মাঝে তিনটি গোঁজ আছে । এটিকে গ্রন্থত্রয় বলা যেতে পারে হয়তো। সাধকমাত্রেই তাহলে ত্রিশঙ্কু । অনুরূপ তিনটি পাশের কথা ঋগ্বেদে পাওয়া যায় ।
আশা করি তুমি ভাল আছ , আনন্দে আছ । আকাশ ফাঁকা, চোখের সামনেই দেখছি কী ফাঁকা । এই চোখে দেখাটা যদি দেহের অণু –পরমাণুর দেখা হয়ে ওঠে, তাহলেই মুক্তি । তুমি তখন আকাশ-কুসুম – আকাশে ফুটে আকাশেই মিলিয়ে যাবে ।
যাই, স্নেহাশিস।
• তৈত্তিরীয় উপনিষদ
This is the 60 th letter of Patram Pushpam
৬০
হৈমবত
১২।৭।৫৯
সাধনাবস্থায় সবার আগে দরকার সাংখ্যের – নিজেকে প্রকৃতি থেকে আলাদা করে খুঁজে পাওয়া । তারপর বেদান্তের – নিজেকে আকাশ করে ছড়িয়ে দেওয়া । সবার শেষে তন্ত্রের অর্থাৎ আনন্দের প্রেমের আর শক্তির অনুভব । বৈষ্ণবও তো তান্ত্রিক । শাক্ত পুরুষ চিদ্ঘনবিগ্রহ, আর বৈষ্ণব নারী আনন্দঘনপ্রতিমা । অবতারে দুয়ের মিলন । শ্রীকৃষ্ণ শৈব ( বা শাক্ত, যাই বল ) । বেদান্তের অহংগ্রহ উপাসনার জীবন্ত মূর্তি । বৈষ্ণবরা এদিকটা বাদ দিয়ে চলেন । সখীর মাঝে এর একটু আভাস আছে অবশ্য । তাঁরা কৃষ্ণ আর রাধা দুয়ের চেতনাই পেয়েছেন । মহাপ্রভু বলতেন, ‘ মুঞি সেই’ । ঐ তো শৈব বেদান্ত । আবার রাধাও হলেন । তখন বৈষ্ণব । বিগ্রহে পাওয়া সবার শেষে । তবেই পূর্ণতা । কিন্তু অরূপকে না বুঝলে তো রূপের পাওয়া হয় না ।
পাঞ্চরাত্রের চতুর্বূহ্যবাদে বাসুদেব পরম পুরুষ [ তু বাসুদেবঃ সর্বম্, গীতা = সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম, উপনিষদ্ ] সঙ্কর্ষণ তাঁর যোগ শক্তি ( তাঁরই female version যোগমায়া ) । প্রদ্যুম্ন = কাম(তু সোহকাময়ত), তা থেকে জীব সৃষ্টি , তা থেকে অনিরুদ্ধ । জীব ‘ অনিরুদ্ধ’, কেননা সে চিৎকণরূপে জড়ের মাঝে আবির্ভূত হয়েও সেখানে নিরুদ্ধ হয়নি বা আটকা পড়েনি । তাই সে ঊষাকে পেল । চিত্রলেখা গুরু । এ কথাগুলি অবশ্য পৌরাণিক ।
আশা করি ভাল আছ ।
স্নেহাশিস ।
this is the 59th letter
৫৯
হৈমবতী
২৮।৬।৫৯
আপনি থাকাই প্রধান কথা । তাতে চিত্ত শান্ত এবং বিস্তৃত হয় । সেই বিস্তারের মাঝেই তো অবিরোধে সবাইকে আমরা পেতে পারি– আকাশ হয়ে ,আলো হয়ে ।এই না হলেই – যত ঝামেলা কেবল অহং –এর ঠোকাঠুকি ।
গৌড়ীয় বৈষ্ণবদর্শনের মূল সূত্র গুলি এই – পুরুষোত্তমের দুটি বিভাগ, মাধুর্য আর ঐশ্বর্য । মাধুর্য যেখানে প্রধান , সেখানে তিনি কৃষ্ণ আর বলরাম । বলরাম মাধুর্যেরই ঐশ্বর্য । তিনি কৃষ্ণের গোচারণে সহচর, কিন্তু নিকুঞ্জে নন । ঐশ্বর্য যেখানে প্রধান , সেখানে তিনি নারায়ণ চতুর্ভুজ । এই নারায়ণই আবার বাসুদেব । কিন্তু ঐতিহাসিক বাসুদেব ক্ষত্রিয়, ‘গোপাল’ বৈশ্য – এইটুকু মনে রাখতে হবে । বৃন্দাবন লীলা মাধুর্যের আর মথুরা –দ্বারকার লীলা ঐশ্বর্যের । এগুলি অবতার –লীলা, তিনি যখন মানুষ হয়ে আসেন ।
কিন্তু তিনি আছেন আবার মায়াতীত বৈকুণ্ঠে চতুর্ব্যুহ নারায়ণ হয়ে । নারায়ণ = বাসুদেব +সঙ্কর্ষণ (+ আর দুটি ব্যূহ ) বাসুদেব মূল সত্তা, তাঁর যোগ্ঐশ্বর্যের শক্তি সঙ্কর্ষণ । তিনিই জগদ্বিভূতির ভর্তা । এই সঙ্কর্ষণ ক্রমান্বয়ে তিনটি পুরুষে নেমে আসছেন । আদি পুরুষ কারণার্ণবশায়ী , সমস্ত সৃষ্টিপ্রপঞ্চের মূল । সৃষ্টি বহু ব্রহ্মাণ্ডে বিচ্ছুরিত হল । প্রতি ব্রহ্মাণ্ডের তিনি অন্তর্যামী, তিনি গর্ভোদ-শায়ী । প্রতি ব্রহ্মাণ্ডে বহু জীব । প্রতি জীবের হৃদয়ে তিনি অন্তর্যামী, তিনি ক্ষীরোদ -শায়ী । ক্ষীরোদ = শুদ্ধ চিত্ত । এ তাঁর ঐশ্বর্যের বিকাশ । এতে ভক্তিতে মোক্ষ লাভ হয় , তার লীলা আস্বাদনের অধিকারও মিলতে পারে। কিন্তু হৃদয়ে তাঁকে যদি দ্বিভুজ মুরলীধররূপে পাই, মাধুর্যের সন্ধান পাব । আমি তখন হব শেষ পর্যন্ত গোপী । এই ।
চরমসাধ্য গোপীভাবের পথ দেখাবার জন্যই কৃষ্ণ-বলরাম(=বাসুদেব সঙ্কর্ষণ)চৈতন্য নিত্যানন্দ হয়েছেন।
স্নেহাশিস।
This is the 58th letter
৫৮
হৈমবতী
১২।৪।৫৯
চৈতন্য পুরুষ , আর তার বিচ্ছুরণই প্রকৃতি । চৈতন্যের স্বরূপ উপলব্ধি হয় আপনাতে আপনি থাকলে । তখন শক্তির দুটি ক্রিয়া দেখা যায় – একটি ভিতরের দিকে টান, আরেকটি বাইরের দিকে বিকিরণ। দ্বিতীয়টিকে উপনিষদে বলা হয়েছে ব্রহ্মক্ষোভ – সূর্যের মাঝে পারার মত জ্যোতির টলমল অবস্থা ভিতরের দিকে যে টান, আর তাতে যে আত্মানন্দ , সেইটি কৌমারী শক্তি। শক্তি তখন কুমারী, জননী নন । বাইরের ক্ষোভ হল জনয়িত্রী শক্তি। দুয়ের মাঝখানে ভাবলোক। সেইখানে নিত্যরাস। তা কিন্তু কৌমারী শক্তিতে বিধৃত। তাই যোগমায়াকে আশ্রয় করে তাঁর রাস, গোপীদের যোগমায়াকে ভজনা। রাস ব্যাপারটাই কুমার-কুমারীর ভাবল্লাস । কিশোর- কিশোরী আর কুমার–কুমারী একই কথা । ভাগবতে আছে ‘ আত্মন্যবরুদ্ধসৌরতঃ’ । এই কৌমারী শক্তির বিশুদ্ধ রূপটি আবার পাই সখা আর সখীতে। তাঁরা আদি কুমার কুমারীরই কায়ব্যূহ । কবিরাজ গোস্বামী বলেন, শুদ্ধ মনোবৃত্তি। শুদ্ধ = অমলিন, অনাসক্ত। রাধা
কৃষ্ণকে যখন আস্বাদন করছেন, তখন আস্বাদন-দশাতেও তিনি তটস্থা । এই তটস্থাবৃত্তিরা সখী । তিনি সংসক্তা , আবার অসংসক্তাও । কৃষ্ণও তাই। জগতটাও তাই। ওটার মাঝে সংসক্তির যে উল্লাস যাতে সম্বন্ধ বৈচিত্র্য ক্রিয়াপরিণাম ইত্যাদি দেখা দিয়েছে, তা ধরা আছে অসংসক্তিরই বৃন্তে । আকাশ শূন্য বলেই তাতে রং – এর খেলা, শক্তির দোলা।
আজ যাই ।
This is the 57th letter
৫৭
হৈমবতী
৮।৩।৫৯
কাজ যতই থাকুক , আমার নিয়মিত কাজে কোনও ব্যাঘাত হয় না, আর সাপ্তাহিক চিঠি লেখাটা তো আমার নিয়মিত কাজ । তুমি চিঠি লিখতে কোনও সঙ্কোচ করো না।
আমার মাঝে উদাসীনতার ভাব কথায় পেলে ? আমি তো যেমন ছিলাম, তেমনি আছি। কাজ বেড়েছে, তাই গুহাহিত হয়ে আছি । আর এটা আমার স্বাভাবেরই অন্তর্গত । জানি , সৃষ্টি শূন্যতা হতেই সম্ভব।
একটা দিব্যভ্রান্তি আছে বটে, সেটা প্রকাশ পায় রাধার প্রেমবৈচিত্ত্যে । তুমি সতীর দেহত্যাগের যে ছবিটি এঁকেছ, তা সুন্দর হয়েছে, কিন্তু তাঁর জ্বালাকে ভ্রান্তি বলছ কেন ?
আমার কিন্তু মনে হয়, ঐ জ্বালাই রুদ্ররোষে রূপান্তরিত হয়ে দক্ষযজ্ঞকে বিনষ্ট করেছিল । লৌকিক দৃষ্টিতে এ – দেহত্যাগ holocaust মনে হতে পারে- কতকটা যে তাই, তাও অস্বীকার করি না; কিন্তু আসলে ওটা আমার মনে হয় charge of energy into matter. আশা করি ভালো আছ। আনন্দে থেকো ।
স্নেহাশিস নিও ।
This is the 56 th letter
৫৬
হৈমবতী
২৯।৩।৬৯
যা করবে শান্ত থেকে করবে। করবে নয়, হতে দেবে। তুমি নিমিত্তমাত্র । যত ফাঁকা থাকতে পার , আর করেই ভুলে যাবে, যেন তোমার করবার কিছু ছিল নব্যা, নাই ইও – ছট বাল্মীকর মত ।
জিহ্বার আরেক নাম রসনা। ওটি বাইরের রস গ্রহণ করে আবার ভিতরের রসও ছড়ায় বাকের সাহায্যে। রসনা যদি বৈরী হয় তাহলেই তো বিপদ । তখন নেওয়া আর দেওয়া দুটাই ব্যর্থ হয়ে যায়। রসনা জীবনের মূলে, তার মোড় ফেরানো তো সোজা নয়। দেবী কাঞ্চনবর্ণা অর্থাৎ শুদ্ধ সত্ত্বরূপিণী । কিন্তু শুদ্ধ সত্ত্ব এখানে সক্রিয় । রসকে আশ্রয় করে প্রতি মুহূর্তে যে সংযাত বা সংসক্তির সৃষ্টি হচ্ছে, তিনি তা চূর্ণ করে দিচ্ছেন। আসলে ব্যাপারটা আহারশুদ্ধি এবং সত্ত্বশুদ্ধির। ‘আহারশুদ্ধৌ সত্ত্বশুদ্ধিঃ’ ।
দেবীর চরণ স্পর্শে অসুরের রূপান্তর শুরু হয় বটে, কিন্তু শেষ হতে দেরী লাগে। মহিষাসুর রূপান্তরিত হয় শুম্ভ নিশুম্ভে। তাঁরা হল নকল শিব। সোনা বটে , কিন্তু খাঁটি সোনা নয় ।
পেয়ে বারবার হারাতে হয় । হারাতে হারাতে শূন্যতার একটা সংস্কার জন্মে যায়। তখন দেখি – শূন্যতা হতে পূর্ণতার নিত্য উৎসারণ। শেষ এইখানেই।
প্রকৃতি স্ফুরণের মুখে কুমারী । আবার ষোড়শীর ঊর্ধ্বে সপ্তদশী যখন তখনও কুমারী । দুটি ভাবের মাঝখানটায় সে জননী। জননীতে বিভূতির প্রকাশ। আর কুমারী হল সহজ এবং শূন্যতা। ভাগবতে সতী কুমারী । উমা কুমারজননী।
ষোল কলার পনের কলা পর্যন্ত হ্রাসবৃদ্ধি। আছে। ষোড়শী কলা নিত্যা। প্রাচীন গ্রন্থে রাধার এক নাম চন্দ্রাবলী-অর্থাৎ চাঁদের কলার পর কলা। কেউ তাকে ভালবাসে এক কলা দিয়ে কেউ দু কলা দিয়ে ইত্যাদি। সবাই চাঁদের মেয়ে, সবাই ফুটছে, তবুও শক্তির তারতম্য আছে। পূর্ণ প্রকাশ ষোলকলায় । তাই রাধা । চন্দ্রাবলী পর্যন্ত ঘৃতস্নেহ , আর রাধাতে মধুস্নেহ । চন্দ্রাবলী আর কিছু চাইল না । কিন্তু রাধা তাঁকে পায় বা চায় প্রতি রাত্রেই । ভক্তের জয় তখন ভগবানের চাইতেও বেশী ।
আশা করি ভাল আছ ।
স্নেহাশিস নিও ।
This is the 55th letter
৫৫
হৈমবতী
১৩।৯।৫৮
পুরুষ যদি একটু উন্মুখ থাকে, তাহলে নারীহৃদয়ের মাধুরীতে তার কামচেতনার রূপান্তর হয় প্রেমচেতনায়, নারী তাকে আত্মপ্রতিষ্ঠ করতে সাহায্য করে- এটা সত্য । আমি তার একাধিক দৃষ্টান্ত দেখেছি –যা বাইরের থেকে মনে হবে অবিশ্বাস্য । পশুপতি ভট্টাচার্যের ‘সহজ মানুষে’ ওইরকম একটা ঘটনার বিবৃতি আছে। ওটা আমারই একটা জানা কাহিনী।
‘অসতো মা সদ্গময়’ ইত্যাদি মন্ত্রটিকে প্রয়োগ করতে বলা হয়েছে পবমান সোমের অভ্যারোহের বেলায়। পবমান সোম হল সুষুম্নার ভিতর দিয়ে চেতনার ঊর্ধ্বপ্রবাহ । ধারা উঠে যাচ্ছে এই ভাবনা সহ এই ভাবনা সহ ঐ মন্ত্রটি জপ করা চলে। অসৎতম মৃত্যু সবি হল মূলাধারে কুণ্ডলিত চেতনা । তা সহস্রারের দিকে উঠে যাক- দেবতার কাছে, এই প্রার্থনা করতে হবে। সহস্রারে আহে সৎ -জ্যোতি –অমৃত। আমরা এখন বলি সৎ-চিৎ-আনন্দ । সুষুম্নাবাহী যে নাড়ীস্রোত, তাই প্রাণস্রোত। প্রানের স্বাভাবিক গতি ঊর্ধ্বমুখী, বিস্তারের দিকে, আকাশবতৎ সর্বব্যাপিত্বের দিকে, অপান তাকে টেনে নামিয়ে জীবদেহে বন্দী করেছে। কিন্তু প্রাণ সর্বদাই এই মধ্যাকর্ষণের টান কাটিয়ে ওঠবার চেষ্টা করছে। তাইতে সৎ ( স্থৈর্য , শান্তি) চিৎ (আলো) আর আনন্দের দিকে আমাদের স্বাভাবিক প্রবণতা। মন্ত্রটি এই প্রবণতাকে কার্যকরী করতে সাহায্য করে। ভাবনা করতে হবে, একটি জ্যোতিধারা যেন মূলাধার থেকে সহস্রারের দিকে উঠে যাচ্ছে ।
আজ যাই । ভাল থেকো, আনন্দে থেকো ।
স্নেহাশিস ।
This is the 54 th letter
৫৪
হৈমবতী
৩।৮।৫৮
পূজার সময় হিমালয়ে থাকবার ইচ্ছা । মহাশ্বেতা হৈমবতীকে কতদিন দেখিনি ।
তনয়াই যদি জায়া হয়, তাহলেই কিন্তু দাম্পত্য জীবনটাও সুখের হয়। স্মৃতিটিতে বিধান আছে, ত্রিশ বছরের যুবা বারো বছরেরে মেয়েকে বিয়ে করবে। বয়সের এই তফাতটা যৌন জীবনের মাঝে সামঞ্জস্য আনবার পক্ষে খুবই অনুকূল স্বামী তো শুধু সখা নয় , গুরুও । যেমন ধর, রামকৃষ্ণ – সারদার বেলায় । মেয়ের ভালবাসা পূজা হয়ে ওঠবার যদি সুযোগ পায়, তাহলেই তা সার্থক হয়। অবশ্য পূজা জোর করে আদায় করা যায় না । পুরুষের মহিমার কাছে নারীর মন আপনি লুটিয়ে পড়ে। আর এই লুটিয়ে পড়াটা যখন আত্মদানে পর্যবসিত হয়, তখনই দাম্পত্য সম্বন্ধ মধুর হতে পারে , আমাদের বাল্যবিবাহ প্রথার মাঝে আত্মিক উৎকর্ষের এই সুযোগটা ছিল । এটাকে আমি নিছক খারাপ বলতে পারি না ।
বয়সের ব্যবধানটা কম হলে সম্ভোগের দিকটা আপনা থেকেই বড় হয়ে দেখা দেয়। পুরুষ নিজেকে সামলাতে পারে না, ফলে নারীর মনেও স্বামীর প্রীতি অশ্রদ্ধা দেখা দেয়। আর নারীও যদি ভোগে প্রমত্ত হয়ে ওঠে, তাহলে তো আরও সর্বনাশ । বর্তমানে ঘরে ঘরে দেখছি তাই। কিশোরীর আত্মসমর্পণের বালাই আজকাল কোথাও নাই ।
মনে পড়ে আমার একটি কবিতায় আমি এই কথাটাই বলতে চেয়েছিলাম। -
ধূর্জটী উদাস –আঁখি দিগন্ত পিয়াসী –
উমা মুখে খোঁজে গৌরী কুমারীর ছবি।
আমাদের জীবন থেকে ‘গৌরী’ বুলি চিরদিনের মত হারিয়ে গেছে। বালা বা কিশোরীর মধুরারতিই যে কি অমৃত, তা যে পেয়েছে সেই জানে।
তাই তো বলি, দুহিতা যদি জায়া হয়, তাহলেই মধুরভাব সম্পূর্ণ হয় ।
ভাল থেকো।
স্নেহাশিস ।
This is the 53 rd letter
৫৩
শিলং
১৭।৮।৫৮
এবার তোমার প্রশ্নোত্তরী ।
রাণের মাঝে ইতিহাস এবং কল্পনার মিশ্রণ আছে । কল্পনা মানে মিথ্যে নয় কিন্তু – ওটা ভাবের সত্য, আর ইতিহাস হল বাস্তবের সত্য । জীবনের কি ও –দুটি মিলিয়ে নাই ?
পুরাণে শ্রীকৃষ্ণ আর গোপীদের সম্বন্ধে যে বর্ণনা আছে,তার একটা বস্তু-আশ্রিত ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে । সে দৃষ্টিতে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে গোপীদের পুনর্মিলন সত্য ঘটনা। আবার তিনি সেখানে গোপীদের দীক্ষা দিলেন, এটাও সত্য ঘটনা। দীক্ষা ব্যাপারটা বীজাধানের মত। শ্রীকৃষ্ণের গুরুশক্তি গোপীদের মাঝে সঞ্চারিত হল তাতে। প্রাকৃত জগতেও দেখি, প্রিয়াই জননী হয় ; প্রেমে, কর্মে, লোক কল্যাণে সার্থকতা লাভ করে। এটা হল শ্রীকৃষ্ণের সমস্ত জীবনের ঐতিহাসিক বিচারের দিক।
কিন্তু ইতিহাসের গোপীকে আমরা কল্পনায় আবার নতুন করে গড়লাম। এখন তুমি বাইরের গোপীদের ভুলে যেতে পার । গোপীরা আজ কেউ বেঁচে নাই। কিন্তু গোপীসত্তা তো আছে। আমাদের হৃদয়ে সে-সত্তা ক্রমে প্রস্ফুরিত হয়ে চলেছে। দীক্ষিতা গোপীদের পরবর্তী বিবর্তনের বিবরণ পুরাণে নাই, আছে আমাদের হৃদয়ে। প্রেমের বিবর্তন হয় অন্তহীন অভিসারে। সেখানে পেয়ে তৃপ্তি নাই, পাওয়া কোনওকালেই সম্পূর্ণ হয় না । বিপ্রলম্ভই হয়ে ওঠে প্রেমের চরম পরিণাম । তাইতে দেখি, বাস্তব গোপীরা কৃষ্ণকে পেল , তাঁর ব্রতে দীক্ষাও হল – কিন্তু ভাবের গোপীরা কোন দিনই তাঁকে পেল না! সেই না-পাওয়ার বেদনার মূর্ত বিগ্রহ হলেন শ্রীগৌরাঙ্গ । পুরাণের উহ্য অংশটুকু তাঁর জীবনে রূপ ধরল।
প্রজাপতির দুহিতৃ-গমনের কথা ঋগ্বেদের বহু জায়গায় আছে। ব্যাপারটা একটা fact । আমার কোনও কোনও কবিতায় আমি একে “নন্দিনী দয়িতা” বলে উল্লেখ করেছি । রবীন্দ্রনাথের ‘বালিকা বধূর’ কথা মনে আছে ? এই যে নবীনা বুদ্ধিবিহীনা – এ তব বালিকাবধূ‘ই, তার মূলে ঐ ভাব।
কথাটা এই । পুরুষ পূর্ণ নিত্য জাগ্রত । সেই পুরুষের সামনেই প্রকৃতি ধীরে ধীরে বিকশিত হয়ে উঠছে। তন্ত্রে বলা হয়েছে ষোল কলায় বিকাশ। প্রত্যেকটি কলায় কুমারী কন্যা। কিন্তু পুরুষের দৃষ্টিতে ওই কণ্যাই তো একদিন জননী হবে । দুহিতৃ গমন ছাড়া সেটা সিদ্ধ হয় কি করে ? দুহিতাতে গর্ভাধান করলে তবে জগৎ সৃষ্টি। সেই জগতে পুরুষের বিগ্রহ দেখা দেবে । অরূপকে রূপ দেবার অশ্রান্ত তপস্যা চলবে প্রকৃতির। এই তাঁর মাতৃত্ব। মাতৃত্বের অবসানে প্রকৃতি আবার পুরুষে লয় হয়ে যাবে । আবার কন্যা হয়ে ফুটবে – আবার জননী হবে । পুরুষ কিন্তু নির্বিকার। তাঁর দৃষ্টিতে প্রকৃতি পর্যায়ক্রমে কুমারী এবং মাতা। এই পুরুষ যখন “অবতীর্ণ” হন। অর্থাৎ যোগমায়ায় বিগ্রহবান্ হন, তখন ‘কপট-মানুষ’ হন বলে তাঁতেও বাল্য কৈশোর ইত্যাদি দেখা দেয়। কিন্তু তাঁর পরম ভাব – অবিকৃতই থাকে। সত্যকার পুরুষ প্রিয়ার মাঝে দুহিতাকে অনুভব না করে পারেন না - কেননা প্রিয়া যে তারই rib হতে সৃষ্ট ।
আশা করি বুঝতে পেরেছ।
স্নেহাশিস।
This is the 52 nd letter
৫২
হৈমবতী
৯।৮।৫৮
মানুষের সঙ্গে চলতে গিয়ে প্রত্যাশা ছাড়তে হয় সবার আগে । কিছু প্রত্যাশা করলেই আঘাত পাবে । যা আসবে, আস্তে দাও – আগে থেকে কিছু ভেবে রেখো না । তারপর সমুদ্রের ঢেউ তোমার উপর দিয়ে গড়িয়ে যাক। তুমি আবার সব ভুলে গিয়ে আপনাতে আপনি থেকে যাও।
আশা করি শরীরটা ভাল আছে ।
স্নেহাশিস
Replies