একই গাছের দুটি পাতা
শ্রীমত অনির্বানের তিনটি পত্র
২৪ শে জুন ১৯৭৮ শ্রী অরবিন্দ পাঠ মন্দিরে শ্রীমত অনির্বানের স্মৃতির উদ্দেশে আয়োজিত সভা উপলক্ষ্যে প্রথম প্রকাশিত I
পুর্ণযোগ -সহজ যোগ
আমার যোগকে আমি কি নাম দেব, জানি না I নিজেকে আমি মনেকরি বাংলার বাউল , আমার পন্থাকে বলি সহজ যোগ I পূর্ণ যোগের সঙ্গে এর কোনো বিরোধ আমি দেখতে পাই না I যদি কিছু তফাত থাকে তো সে বাহ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির তফাত মাত্র I আমার যোগকে আমি নতুন বলি না - অনুভব করি এ যেন ভারতবর্ষের হৃদয় ভেদ করে জাগছে I একে ব্যাখ্যা করবার জন্য নতুন কোনো পরিভাষা সৃষ্টি কর বার ও তাগিদ অনুভাব করিনা, কেবল দেখি , অনুভবে পুরাতনের ব্যঞ্জনায় আরো প্রাস্ফুত হয়ে উঠছে I কতগুলি OCCULT ব্যাপার সম্বন্ধে আমি চুপ থাকতে চাই, কেননা এতে মানুষের বুদ্ধি বিভ্রম হওয়ার সমভাবনা বেশি I আমার একটা সুত্র হচ্ছে," যা ওখানে আছে তা এখানে ও আছে "- সুতরাং লোকোত্তর কোনো ও অবস্থারও মূল আমি খুঁজি এই খানে I অধ্যাত্ম সাধনাকে জীবম হতে কোনো রকমেই আমি বিচ্যুত বলে মনে করিনা, এজন্য আশ্রাম গড়বার দিকে আমার ঝোঁক নাই I আমি যা বুঝেছি তা বুঝিয়ে যাবার লোক আমি হয়ত পাবনা, কিন্তু তার জন্য আমার দুঃখ নাই কারণ আমার দেখা তো PATENT নয়, এ সূর্যের মতো স্বপ্রকাশ, দেখবার লোক আসবেই .I অখন্ড ভারতকে , তার ঐতিহ্যকে আমি প্রাণ দিয়ে ভালবাসি , যদি ও তাকে অন্ধভাবে আমি আঁকড়ে থাকি না, তাই পুর্ণযোগ ই বল সহজ যোগ ই বল আমি দেখি সবই সেই এক সহস্র পদ্মের দল মেলা I
এই থেকে মনোভাব হয়ত বুঝতে পারবে, এতে বিরোধের কিছুই নাই, অথচ সহজ যোগ আর পুর্ণযোগ যে হুবহু এক তাও যেন পুরোপুরি মানতে পারছি না I এক ই গাছের দুটি পাতা এক হয়ে ও এক হয় না এ যেন তেমনি I ১৯৩৯ ন্সালের আগে আমি শ্রী অরবিন্দ সম্বন্ধে কিছুই জানতাম না I কিন্তু তার আগেই আমার জীবন দর্শন দানা বেঁধে গেছে, আমার নানা লেখায় তা রূপ ও পেয়েছে - তার কিছু প্রকাশিত হয়েছিল ,কিছু হয়নি, তাই ১৯৩৯ সালে LIIFE DIVINE যখন হাতে এলো , তখন ভাবের সাম্য দেখে বড় আনন্দও পেয়েছিলাম I
এই গেল ইতিহাস, I আমার দর্শনকে কে একটা সুস্পষ্ট রূপ দেবার ইচ্ছা আছে,' উত্তরায়ন' নামে এক খানা বই এ I অনেকদিন ধরে তা মাথায় ঘুরছে I সামনের বছর কাজে হাত দেবার ইচ্ছা I তখন হয় তো আমার কথা আর ও স্পষ্ট করে বলতে পারব I কিন্তু কারো ও সঙ্গে আমার কোনো ও বিরোধ থাকবে না , এ ধরে নিতে পার I
সমাপিকায় বলতে চেয়েছি প্রত্যেক পুরুষের মাঝেই চলছে মহাশক্তির একটা তপস্যা - পুরুষের স্বরুপকে বিশ্বে সামনে অনাবৃত করবার জন্য I অন্তরের গভীরতম প্রদেশে পুরুষ উদাসীন প্রকাশ হোক বা না হোক, তাতে তাঁর কিছু আসে যায় না, কিন্তু আশ্চর্য, এই ঔদাসীন্যই শক্তি হয়ে ফোটে ,সংখ্যার ভাষায় জ্ঞানের পরিনাম দেখা দেয় ঐশ্বর্যে, সেই ঐশ্বর্যের শক্তি যখন জ্ঞানের রিক্ততার মাঝে বৈচিত্র্যের উল্লাস ফুটিয়ে তুলতে থাকে তখন পুরুষ নিজেই নিজের বৈভবে মুগ্ধ হয়, বলেন, এ কি ! তাঁর এই বিস্ময়ে শাকি যেন মিগ্ধা বালিকার (মতো) তাঁর বুকে আবার মিলিয়ে যান I এই বালিকাকে আমি বলেছি 'অষ্টা দশী' -একেই আমি জানি আমার সহজ যোগের সাবিত্রী বলে I
তৃতীয় মন্ত্রের ভাবটা সোজা কথায় এই I তোমার মাঝে সত্যকে জানবার অভীপ্সা আগুনের শিখা হয়ে জ্বলে ওঠে এবং তা ভ্রুমধ্যে উজানে মহাশুন্যের গিরে প্রবিষ্ট হয় I ওটি নির্বাণ লোক I কিন্তু সেখানে গিয়ে সে আগুন নিবে যায় না I যে জন্ম সিদ্ধ তার চেতনায় সেই আগুন একটা নতুন সৃষ্টির প্রবর্তনা নিয়ে দুর্জয় সংকল্পের শক্তি হয়ে নেমে আসে I চারদিককে সে তখন গড়তে চায় নতুন করে এই যে অগ্নিশক্তি, এই মূল রয়েছে, তোমার ই প্রানের গভীরে HEART CENTRE এর অতলে I তাকে সুব্যক্ত করলে পরে ই দ্যুলোকে আর ভূলোকে ,. ওপারে আর এপারে কোনো ও ব্যবধান থাকে না I সব আনন্দ ময় হয়ে ওঠে I
৬.১১.৫৫
To be continued ....................
মহাবাক্য -বিচার
শ্রী অনির্বাণ
অয়ামাত্মা ব্রম্হ মহাবাক্যাটি বৃহদারন্যকে ও আছে I চার বেদেরই চারটি মহাবাক্য চাই - তাই ওটি মানডুক্য থেকে নেওয়া বলে দেখানো হয় I বস্তুতো মানডুক্য উপনিষদ বৈদিক ধারার শেষ উপনিষদ I অর্বাচীন উপনিষদের আদি হতে পারে বটে I কেউ কেউ বলেন, ওটি গৌড় পাদের রচনা I
মহাবাক্য গুলিতে অধ্যাত্ম ভাবনার বিকাশ এই রকম - প্রথমে 'তত্বমসি ' -এটি আচার্যের মুখে শোনা, বা শ্রবণ একবার শুনে ই বোধ হয়ে গেলে অধিকারী উত্তম I না হলে বার বার শোনাতে হয়, শ্বেতকেতুকে অনেকবার শুনতে হয়েছিল I লক্ষনীয়, শ্রী কৃষ্ণ অর্জুনকে স্বরূপ কথা শুনিয়ে ছিলেন গীতাতে I সংর ফলে বোধ হয়, 'আয়মাত্মা ব্রম্হ' I লক্ষনীয়, 'আত্মা' -অহং নয় I আগের মহাবাক্যাটিতে ছিল 'ঐতদাত্ম্যাম ইদং সর্বম' , 'তত সত্যং স আত্মা' -সেই আত্মার অনুবৃত্তি এখানে I আগেরটিতে তত ও ত্বম পদার্থের শোধনের বিধান আছে বেদান্তে I 'ত্বম' বিস্ফারিত হলো, 'তত' সংকুচিত হলো - ভাগ ত্যাগ লক্ষনায় চিদাংশে দুয়ের সাম্য হলো I তাইতে 'তত্ত্বমসি ' থেকে সাধনার শুদ্ধ পরিনাম এই বোধ : 'অয়মাত্মা ব্রম্হ ' I এখানে ভাগত্যাগলক্ষনার প্রয়োজন রইলো না I এই মহাবাক্য মননের ফল I তার পরের ধাপ -অহং ব্রহ্মাস্মি ' I 'তত্ত্বমসি ' ড় ত্বম এর মধ্যে যে অহং প্রচ্ছন্ন ছিল , এবার তা স্বরূপে ফিরে এলো - কেননা এ - অহং , এ মহাবাক্যের আদি প্রবক্তা ব্রম্হ স্বয়ম I এ অহং MOSES এর সেই বিখ্যাত - I AM THAT I AM I এটি নিদিধ্যাসনের দিক I
তারপরের ধাপ - ' প্রজ্ঞানং ব্রম্হ' I এটি সহজ অবস্থা I এই প্রজ্ঞানের মধ্যে আছে হৃদয় মন সংস্থা , অজ্ঞান ...........ক্রতু, পশু , কম, যশ. ইত্যাদি সব তখন 'সর্বং খল্বিদং ব্রম্হ' - বাইরে ভিতরে সর্বত্র I শিব দর্শনে এটি তুর্জাতীত অবস্থা, তুরীয় থেকে ফিরে এসে সহজ হয়ে থাকা I চ্ছান্দগ্যের উত্তম পুরুষ হয়ে I এটি সাক্ষাত দর্শন I
অত এব চারটি মহাবাক্য আত্মার দর্শন, শ্রবন , মনন, নিদিধ্যাসন I
গুরু পূর্নিমা পরিচিতি
অনির্বাণ
গুরুপুর্নিমা হলো আশারী পূর্নিমা, আরেক নাম ব্যাস পূর্নিমা I বুদ্ধ দেবের ধর্ম চক্র প্রবর্তনেরও ওই তিথি I আশার অম্বু বাচি প্রবৃত্তির সঙ্গে ও এর সম্পক আছে.I
এর ইতিহাসটা অতি প্রাচীন I এই তিথির গুরুত্ব নির্ভর করছে সুর্যায়ানের উতারায়ান গতির উপর I বৈদিক ঋষিরা ছিলেন আদিত্যের উপাসক I আদিত্য জ্যোতি ই ব্রম্হ জ্যোতি I জীবনে মরণে আদিত্য গতির অনুবর্তন করাই তাঁদের মতে পরম পুরুষ অর্থ I
আদিত্যের বার্ষিক গতির দুটি বিন্দু লক্ষনীয় I একটি মকর সংক্রান্তি I . আরেকটি কর্কট সংক্রান্তি I মকর সংক্রান্তিতে আদিত্যের উত্তরায়ান শুরু হয়, শেষ হয় কর্কট সংক্রান্তিতে I উত্তরায়নে আদিত্যের আলো ক্রমে বেড়ে চলে I আদিত্য জ্যোতির এই ক্রম প্রসারণকে অনুসরণ করতে হবে I পুরাণে বলা হয় দেবতারা এই সময়ে জেগে থাকেন I .তাই মানুষের সাধনার পক্ষে এইটিই প্রশস্ত কাল I দাক্ষিনায়ান প্রবৃত্তির তিথি হতে তাঁদের রাত শুরু হয় I
সারা বছর ধরে দেবতাদের দিনরাতের আবর্তন চলছে I এই আবর্তনের উর্দ্ধে আমাদের যেতে হবে I যেখানে কেবল ই আলো, আঁধারের চ্ছায়ামাত্র নাই I
আলোর আনুকূল্য নিয়েই জ্যোতির অভিযানের শুরু হবে I তাই জ্যোতি:সাধনার আদিতিথি হলো উত্তরায়নের আদিবিন্দুতে অর্থাত মকর সংক্রান্তিতে I পৃথিবীর নানা দেশে প্রাচীন কাল হতে ই এই দিনটিকে একটি বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে I খ্রিস্টান দের মধ্যে এই দিনটি তেই খ্রিষ্টের জন্ম, অর্থাৎ মানুষের মাঝে আলোক শিশুর আবির্ভাব.I
আলো বাড়তে বাড়তে চরমে পৌছল কর্কট সংক্রান্তিতে I সেই দিনটি ই সব চাইতে বড়দিন I যদি সেদিন পূর্নিমা পরে, তাহলে দিনে রাতে আলোর বিচ্ছেদ কখনো হয় না I কর্কট সংক্রান্তিতে পূর্নিমা সব বত্সর হয় না. I বহুযুগ পূর্বে যেদিন হয়েছিল সেই দিনটি ধরে ব্য্যাস পূর্নিমার প্রবর্তন করা হয়েছে I
এই দিনটিতে সাধকের চেতনা নিত্য জ্যোতিতে উত্ত্তির্ণ হল I কিন্তু প্রকৃত জগতে তারপরেই তো আবার আলো কমতে থাকবে I আলোর এই হ্রাসকে পরাভূত কর্তে হবে I এই প্রভাবের ইঙ্গিত আছে 'আশার ' সংজ্ঞার মাঝে I আশার নক্ষত্র সেইটি, যা আঁধারের সমস্ত বাধাকে অভিভূত করেছে I সহ ধাতুর প্রাচীন অর্থও চিও অভিভূত করা, ঋগ্বেদে এই অর্থ ই আছে I সহ্য করার অর্থ অনেক পরে এসেছে I আঁধারের বাধা 'আসার ' বা অভিভূত হলো যাঁর দ্বারা তিনি অভিজিত I মানুষের মাঝে তিনি ই জিন বা বিজয়ী বীর I দেবতার মাঝে তিনি ইন্দ্র I পৌরানিক ইন্দ্র নন I বৈদিক ইন্দ্র , যিনি আদিত্যের মাধ্যন্দিন দ্যুতি I অভিজিত নক্ষত্র ও আছে, তা নক্ষত্র চক্রের বাইরে, অর্থাৎ তা লোকোত্তর চেতনার প্রতীক I
সিদ্ধির কথা বলতে গিয়ে বৈদিক ঋষি দুটি প্রাকৃতিক ব্যাপারকে উপমা রূপে গ্রহণ করেছেন I একটি সূর্যোদয়, আরেকটিই বর্ষা আরম্ভ I সূর্যোদয়ে আঁধারের প্রারাভাবে জ্যোতির উদয়ন I আঁধারকে সেখানে বলা হয়েছে 'বৃত্র' বা আবরিকা শক্তি I সূর্য দয়ই হলো বৃত্র সংহার I বেদান্তি বলবেন অবিদ্যানাশ I এইটি মনোভূমির ব্যাপার বৈদিক ঋষিদের ভাষায় দ্যুলোকে র ঘটনা I
সিদ্ধির আরেকটি বাধা হচ্ছে প্রানের শুদ্ধতা I ঋগ্বেদে তাকে বলা হচ্ছে 'শুষ্ণ' I সে ও অসুর , বৃত্ত্রের অনুচর I জীবনকে সে মরুভূমি করে দেয় I ঋগ্বেদে একেই বলা হয়েছে বৃত্ত্রের সপ্ত সিন্ধুনিরোধ অর্থাৎ নাড়ীতে নাড়ীতে প্রাণ স্রোতের ধারাকে অবরুদ্ধ করে রাখা I এই অবরোধ ও ভাঙ্গেন ইন্দ্র বজ্রের আঘাতে I তখন উর্ধ্ব হতে অমৃত প্লাবনে জীবনের বন্ধ্যাত্ব ঘোচে I প্রকৃতিতে এইটি নিদাঘের শেষে বর্ষার ঢল নামা I এইটি অন্তরিক্ষের বা প্রানলোকের ব্যাপার I
বিষুবরেখার উত্তরে একটি আশ্চর্য ব্যাপার ঘটে I যে সময়ে দিনের আলো সব চাইতে বেশি হয় সেই সময় ই বর্ষা ও শুরু হয় I অম্বু বাচি প্রবৃত্তির এই সময় আলো জয় হলো, প্রানের বন্ধ্যাত্ব দূর হলো, অমৃত প্লাবনে আমার আত্মপ্রকৃতি অথবা বিশ্ব প্রকৃত্তি হলেন বিশ্ব জননী , শক্তি সার্থক সৃষ্টিতে মুক্তি পেল I এই সব ব্যাপার গুলি জড়িয়ে আশার পূর্নিমা I সং বত্সরের সার্থক তম তিথি I
একদিন এই তিথিটি উত্সৃষ্ট ওয়েছিল ব্যাসের উদ্দেশ্যে I কেননা ব্যাস ই ভারত বর্ষের গুরু, জগতের গুরু I ব্যাস চেতনায় গুরুচেতনা I আশার পূর্নিমা তারই প্রতীক I সম্যক সম্বুদ্ধের ধর্ম চক্র ও
(=আদিত্য, জ্যোতি:)প্রবর্তিত হল এই তিথি I গুরুশক্তি হলেন অপরাজিতা I
সূফীবাদ
শ্রীমত অনির্বান
১
Mystic ক়ে বাংলায় বলে মরমীয়া I. ধরম আর মরমে তফাত করেছেন এ দেশের সহজিয়ারা I. সূফীরাও তেমনি শরীয়ত আর হকীকাতে তফাৎ করেছেন.I শরীয়ত বাইরের বিধি বিধানে প্রকাশ পায়, যেমন বৈষ্ণবের বৈধীভক্তিতে I.হকীকাত বিশ্বমর্মগ্রাহী -- যেমন বৈষ্ণবের রাগমার্গে I. প্রেম সূফী ধর্মের অন্যতম স্তম্ভ I. প্রেমে দেওয়ানা হওয়া -- ঈশ্বর প্রেমে উন্মত্ত হওয়া -- এই থেকে mysticism এর উত্পত্তি I, আসলে mysticism হচ্ছে ,যা অতীন্দ্রিয় তাকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যবত প্রত্যক্ষ করা --তত্ত্বদৃষ্টিতে বা ভাবের দৃষ্টিতে I.
মনে কর , ঈশ্বরবিশ্বাস I. সবারই তা কিছু কিছু আছে. I কিচ্তু সে অনুভব সবার কাছে তো ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ এর মত সহজ বা স্বাভাবিক নয়.I চৈতন্য মহাপ্রভু কৃষ্ণপ্রেমে পাগল হয়ে গেলেন --তার 'জাঁহা জাঁহা দৃষ্টি পড়ে,তাঁহা তাঁহা কৃষ্ণ স্ফুরে.' I এই অতীন্দ্রিয় অথচ প্রত্যক্ষ এবং মার্মিক অনুভূতি , এই হল mystic অনুভূতি.I রামকৃষ্ণের অনুভূতি ও mystic অনুভূতি I.সূফীরাও অনেকে ঈশ্বর প্রেমে মত্ত হয়ে তাকে সর্বত্র অনুভব করতেন I. এ অনুভব ইন্দ্রিয় বোধের চাইতে ও তীখ্নো I. আর এই হল mysticism এর প্রাণ I.
২
সুফি মত টাই একটা mystic approach to Reality ওটা mysticism হতে আলাদা কিছু নয় I.
সব ধর্মের ই একটা বহিরঙ্গ আর একটা অন্তরঙ্গ দিক থাকে I.সূফীমত হল ইসলামের অন্তরঙ্গ দিক I. বহিরঙ্গ নিয়ে ধর্মে ধর্মে লাঠালাঠি আছে-- হিন্দু মুসলমানে লাঠালাঠি টা স্রেফ এই নিয়ে. I সব হিন্দু বা অধিকাংশ মুসলমান যদি সূফী হন, তাহলে দুটি ধর্মের মধ্যে হাজার হাজার বছর ধরে এই বেদনাদায়ক হানাহানিটা থাকত না I.
ছেলেবেলায় পূর্ববঙ্গের সাধারন মুসলমানদের মুখে এমন সব কথা শুনেছি, যা বড় হয়ে জেনেছি সূফীবাদেরই অঙ্গ I. অথচ এমনটি পশ্চিমে দেখিনি I. হিন্দুর যোগ আর বেদান্ত আর মুসলমানের সূফীবাদ দুই এসে মিলতে শুরু করেছিল বাংলার বাউলদের মধ্যে I.বাউলদের যদি ভাল করে বুঝতে পার , তাহলে সূফীবাদের মর্মে প্রবেশ করতে পারবে I.
প্রবল ঈশ্বরানুরাগ -- এই হল সূফীবাদের গোড়ার কথা I. কিন্তু এ অনুরাগ রূপের প্রতি ততটা নয় , যতটা অরূপের প্রতি I. অনুরাগের কথা ভাবতে গিয়ে হিন্দু রূপের কথা না ভেবে পারেন না I. আর সূফী রূপ মানলেও ভাবকে তার উপরে স্থান দেন I. দুয়ের তফাত টা এত মারাত্মক নয় I. প্রমান মেলে সূফী কাব্য আর বৈষ্ণব কাব্যের তুলনা করলে I.
৩
সূফী নামটির ব্যুত্পত্তি নিয়ে মতভেদ আছে I. কেউ বলেন ,. তার মূল হচ্ছে 'সফা' (পবিত্রতা ) Iঅতএব তিনি ই সূফী যিনি পার্থিব সব মালিন্য থেকে মুক্ত I. কেউ বলেন 'সফ ' (উচ্চপদ ) থেকে সূফী , কেননা সূফীরা ঈশ্বর প্রেমিকদের মধ্যে অগ্রণী I, আবার কেউ বলেন ,সূফীরা বড় গরিব ছিলেন , কেননা সর্বস্ব ত্যাগ করাই ছিল তাদের ধর্ম I. তাই গরিব মুসলমানের যেমন মসজিদএর বাইরে 'সুফ্ফা ' বা বেঞ্চে রাত্কাটাতেন ঘরের অভাবে , এরাও তাই করতেন, তাই এদের নাম হয়েছিল সূফী I. কিন্তু এসব ব্যুত্পত্তির কোনটাই ভাষাতত্ত্বের দিক কয়ে যুক্তিসহ নয় যদি ও ভাবের দিক দিয়ে আপত্তি করার কিছু ই নাই I. সূফীদের সম্বন্ধে সর্ব প্রাচীন গ্রন্থকার আল -সরহাজ বলেন , আসলে শব্দটি এসেছে 'সূফ ' থেকে, যার অর্থ হল পশম I. ইসলামের প্রথম দু শতাব্দী ধরে এই সব সূফীরা ক্রিশ্চান সন্ন্যাসীদের মত পোশাক পরতেন , তাইতে ফরাসিতে তাদের বলা হত 'পশমিনা সূফ ' বা পশমের পোশাক পরা I. তাই থেকে তাদের নাম হয়েছে সূফী. আধুনিক পন্ডিতেরা সূফী শব্দের এই ব্যুত্পত্তি ই মেনে নিয়েছেন I.
প্রথম সূফীরা তাহলে গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীর মতন ই থাকতেন --এইটি লক্ষনিয়. সূফীবাদের গোড়ায় তাহলে আমরা পাচ্ছি একটা তীব্র বৈরাগ্যের প্রেরণা I.কিন্তু এই বৈরাগ্যের মূলে যদি প্রেম না থাকে তাহলে তা আত্ম্পিরনে পর্যবসিত হয় I.সূফী বৈরাগে হয়েছেন ঈশ্বর প্রেমে. ঈশ্বরের প্রেমে দেওয়ানা হয়ে যাঁরা 'ধর্মের উপর মরম' ক়ে স্থান দিয়েছেন (আমি বাংলার সহজিয়াদের পরিভাষা ব্যবহার করছি)I, সেই মরমিয়ারাই সত্যকার সূফী .আজকাল আমরা সূফী বলতে এই মরমিয়াদেরই বুঝি I. বছর তিনেক আগে আমিই দিল্লিতে একজন কাশ্মিরি সূফীর সংস্পর্শে এসেছিলাম. ইনি আমাদের সঙ্গে সঙ্গে মথুরা বৃন্দাবন ইত্যাদি সব তীর্থে তীর্থে ঘুরলেন I. আমরাও তাঁকে আমাদের একজন বলে মন্দিরে পর্ষন্ত ঢুকিয়েছি I. দেখেছি, কৃষ্ণের নামে তাঁর চোখ দিয়ে জল পড়ছে I.সমস্ত গোড়ামির উর্ধে ধর্মের বিশ্বজনিনতায় এইযে ঐকান্তিক শ্রদ্ধা ,সর্বত্র ঈশ্বর - দর্শনএর এই যে মর্মগত তাই হল সূফী ধর্মের প্রাণ I
DEHRI -ON -SONE
30 . 1 .36
ভাই হীরেন,
ভাই, এই কথাটি প্রাণে প্রাণে বুঝিতে পারিতেছ যে আমাদের অহং বুদ্ধির মাঝে ই আমরা অহর্নিশ ডুবিয়া রহিয়াছি , তাঁহারই মাঝে চলিতেছি, ফিরিতেছি, অথচ প্রতি মুহুর্তে সেই অখন্ড আনন্দ স্বরূপ হইতে নিজেকে পৃথক করিয়া একটা অকর্মান্যা দাম্ভিক আমাকে খাড়া করিয়া রাখিয়াছি I এই যে অনন্ত বায়ু - সমুদ্রে আমরা ডুবিয়া রহিয়াছি একি তার ই নি:স্বাস নয় ! এই ক্ষুদ্র প্রাণ সেই অনন্ত প্রানের একটি ক্ষুদ্র তরঙ্গ নয় ? এই যে চেতনা, তার ই অনন্ত জ্যোতির একটি কিরণ নয় কি ? অথচ প্রতি পদে তাঁহাকে অস্বীকার করিয়া বড় হইয়া দাঁড়াইয়াছে আমাদের এই "অহং" I তার সঙ্গে যে কতবড় বিচ্ছেদ, কি মর্মান্তিক বিরহ তাহাওকি আর বুঝাইয়া বলিতে হয় ?
উপায় কি ? যে পথেই যাই না কেন, দেখিয়াছি ঋষির উপদেশ - "শান্ত উপাসীত ' - শান্ত হইয়া উপাসনা করিবে I তার স্বরূপ তোমনের বিকার নয়, কল্পনা দিয়া তো তাঁকে ধরা যায় না I সমস্ত তাঁহাকে সপিয়া দিয়া শান্ত হইয়া অনন্ত সত্তায় যদি আমরা ডুবিয়া যাই , প্রতি নি:শ্বাসে যদি অনুভব করি মাতৃ গর্ভস্থ ভ্রুণের মতো তাঁহারই সত্ত্বা হইতে প্রাণ আহরণ করিয়া বাঁচিয়া আছি, আমি তার অনুতে অনুতে নি:শ্বাস্সে নি:শ্বাসে আমি তাঁর - তখন তিনিই - স্নিগ্ধ জ্যোতিতে তাঁহাকে ফোটাইয়া তোলেন আমাদের হৃদয়ে I তখন বুঝি , এই চোখ হইয়াছে বাহিরের বস্তু দেখিবার জন্য নয়, তাঁহাকে দেখিবার জন্য, এই স্পর্শানুভুতি তাঁহাকে বুকে জড়াইয়া ধরিবার জন্য I তপ্ত বালুতে বারি বিন্দুর মতো তিনি আমায় শুষিয়া নেন I
ভাই !এই প্রশন্ত অন্তর্মুখীনতা টুকু আগে I তারপর এই ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত থাকিয়াই কর্ম, কর্ম তখন সত্য আনন্দময় I কেননা এতো তারই কর্ম I আমি ও তো তাঁরই খেলার সাথী I
তুমি যে বলিয়াছ, সবাইকে তাঁহার কাছে টানিয়া আনিতে প্রবল ইচ্ছা জাগিয়াছে, ইহাও সত্য I এ যুগে তাঁহার ইচ্ছা এই ভবে বিচ্ছুরিত হবে I "সকলের তরে সকালে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে "জানিও , ওই কথা I "শান্ত উপসীত "-শান্ত হও প্রশান্তি স্বাভাবিক , সূর্য কিরণের মতো I প্রভাতের কিরণ যেমন করিয়া ফোটে ......................হৃদয়ের ঠাকুর সবার হৃদয় ফুটাইয়া তুলিবেন I মুখে বলার চেয়ে ........অন্তরের যোগ I জেনো চুম্বকের আকর্ষণ - বাইরে দেখা যায় না ,কিন্তু ভিতরে টান পড়ে I ভাই তুমি তোমার ঠাকুর ঘরটি তপস্যার বির্জ্যে পূর্ণ করিয়া তোল , তপস্যা ঘনীভূত হউক - বিকিরণ স্বাভাবিক ও অনায়াসে I লীলা দেখিয়া অবাক হইয়া যাইবে I লীলা তাঁর ই- অতএব তা অনায়াসে আমাদের মতো ছটফটানি তো নয় I তোমাকে দিয়া তিনি অনেক kAj করাইয়া লইবেন I তাই বলি তাঁহার হাতে একেবারে যন্ত্র বত শান্ত হইয়া যাও I যন্ত্রীর ই শক্তি, তিনিই চালান I মনে, কর,মিস্ত্রির হাতের যন্ত্র ,যদি ইচ্ছা সংযুক্ত হয়, নড়ে চড়ে নিজের ইচ্ছা মতো,তাহা হইলে কি বিপদ !আমরা তাঁহার হাতে যন্ত্র মাত্র - অর্থাৎ শান্ত , কিন্তু অচেতন যন্ত্র নই - পূর্ণ মাত্রায় সচেতন যন্ত্র - তার আলোতে আলোময় I সচেতন বটে কিন্তু স্বাধীন ইচ্ছা নাই - জীয়ন্তে মরা I অথচ অলস নই , জড় নই , লোভী নই -অর্থাৎ আমির বালাই নাই I
তোমদের নির্ব্বাণানন্দ
Replies